মনিকর্ণিকা—বীরভূমের এক নদী-সুন্দরী! তার বেয়ে চলায় কোনও প্রতিযোগিতা নেই। ভূগোলের পাঠ্যাংশে নেই বলে শোভনকে একটু বেশিই টানে এই নদী। মনিকর্ণিকার পাশেই শোভনের গ্রাম—কামারহাটি। গ্রামের অধিকাংশ কামার। এককালীন প্রায় প্রতি ঘরেই কামারশালা ছিল। এখন আর নেই। লোহা থেকে কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী তৈরীর জন্য আশেপাশের গ্রাম থেকে চাষিরা আসত। শোভন মণ্ডল। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে। এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে। সে কর্মকার বংশের ছেলে নয়। শোভনের বাবা পেশায় চাষি। নিজের চোখেই শোভন দেখেছে লাঙলের জায়গায় ট্রাক্টর, কাস্তের বদলে ধানকাটা মেশিন, দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করছে মাঠে মাঠে। কামারহাটির কামার বাড়ির ছেলেরা, যাদের জমি-জমা নেই, তারা এখন কাছের মফস্বল-শহরে যায় কাজ করতে। শোভনও রোজ মফস্বল-শহরে যায়। টিউশন পড়তে। কোনোদিন সকালে, কোনোদিন বিকেলে, স্কুল শেষে। তার অনেক বন্ধুই মাধ্যমিকের পর গ্রামের নিজের স্কুল ছেড়ে শহরের স্কুলে ভর্তি হয়েছে। টিউশনি পড়ার সুবিধার জন্যই। শোভন মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেও যায়নি। বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই সে গ্রামের স্কুলে পড়ে। আলপথ হেঁটে আরও কিছুদিন স্কুল যাবে বলে! কাশের স্পর্শে স্বর্গসুখ নিতে নিতে কেটে যাবে আরও দুটি বছর।
মনিকর্ণিকার ঘাটে মেঘ-চিকচিক রোদ! একপশলা বৃষ্টি শেষে, শরতের আকাশ বড় মায়াবী! আজ স্কুল শেষে টিউশন ছিল শোভনের। যায়নি। মন আজ মনিকর্ণিকার সঙ্গে থাকতে চায়। এই বয়সে কবিতা-ঘোর এলে সর্বনাস পেয়ে বসে। ক্লাস ইলেভেনের রেজাল্ট সে কথাই বলে। নদীর জলে পা’ডুবিয়ে বসে আছে শোভন। জলের গতিবেগে মেপে নিচ্ছে নদীর একপশলা উচ্ছ্বাস! ডাহুক পাখিটি সট্ করে ঢুকে পড়ল কাশের ঝোঁপে। ঝিঁঝিদের ডাক গাঢ় হলে সন্ধ্যা নেমে আসে। শোভন সাইকেলে উঠে পড়ে। বাড়ির উদ্দেশে…
রোজ দু’কিমি সাইকেল তারপর বাস ধরে শহরে যেতে হয় শোভনকে। টিউশন পড়তে গিয়ে সে দ্যাখে বিজ্ঞাপন থৈ-থৈ শহর। মনে পড়ে কবির লেখা কথা, প্রতিটি শহর আসলে মৃতগ্রাম! এরপরের অংশ ভাবতে বসে শোভন। শহর মরলে কি নগর? আর নগর মারা গেলে মহানগর? সেই মহানগরে কি চাপা পড়ে যাবে নাবিকের উচ্ছ্বাস? তাই কি এতো বিজ্ঞাপন ! শোভন ঠিক করে এই সদ্য গড়ে ওঠা মফস্বল-শহরকে বিজ্ঞাপন-মুক্ত করতেই হবে। দেওয়ালে দেওয়ালে ‘বিজ্ঞাপন মারিবেন না’ এই ধরণের লেখাও তো একধরণের বিজ্ঞাপন। বাড়ির বিজ্ঞাপন! সুন্দরের বিজ্ঞাপন! অতেব বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে পালটা কবিতা বা শ্লোগান লিখবে না সে। মনে মনে স্থির করে ফেলে তার পরিকল্পনা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মাঝে মাঝে বন্ধুদের মেসে থেকে যায় শোভন। বন্ধুদের আবদারও আসছিল ক্রমাগত। টিউশন-মাস্টার দেরি করে ছাড়লে বাড়ির অনুমতি নিয়ে, মাঝে মাঝেই বন্ধুদের সঙ্গে থাকে শোভন। রাত বাড়লেই মেসে নেশার ঠেক। বন্ধুদের চাপকে অগ্রাহ্য করে শোভন। রাতের খাওয়ার খেয়ে বেড়িয়ে পড়ে রোজ। বন্ধুরা ভাবে শোভন তো কবিতা লেখে। পাগলাটে স্বভাব! তাই কেউ খোঁজ নেই না, কেন সে রোজ রাতে মেস ছেড়ে শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তার কাঁধে থাকে একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। সেখানেই লুকানো থাকে বিজ্ঞাপন-বধের সব অস্ত্র! মার্কার পেন, হাতুড়ি, সাদাকালির পেন, ফেভিকলের আঠা আর কিছু দেবতার ছবি।
প্রথম দিকের কয়েকটি রাত শুধু গাছেদের গায়ে পেরেক বসানো বিজ্ঞাপন তুলে ফেলে। পূর্বে বিজ্ঞাপন পরিহিত একেকটি গাছে একেকটি দেবতার ছবি আঠা দিয়ে এঁটে দিয়ে কিছুদিন অপেক্ষা করে। কোনও কোনও রাত কিছুই করে না। শুধু দ্যাখে। রাতের নাইটগার্ড গাছের গুঁড়িতে প্রণাম ঠুকে আবার কেমন সাইকেল নিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে যায় দূরে। অনুভব করে দিনের ব্যস্ত শহর রাতে কী শান্ত! রাতের শহরেরও একটা সৌন্দর্য আছে, তা শোভন টের পায়। নির্বাক শহর অনেক কথা বলে শোভনকে! সবই মন দিয়ে শোনে সে। এখানেও রাতপাখিরা নির্দিষ্ট সময়েই একসঙ্গে ডাক দেয়। পেঁচারা ইলেকট্রিক তারে ঝিমোয়। কিন্তু ডাহুক পাখি ডাকে না!
এরপর একেকটি বিজ্ঞাপনী প্রচারের সঙ্গে ব্যঙ্গাত্মক বাক্য লিখতে শুরু করে। যেমন- একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘সুমন্তদার কাছে নিউট্রেশন টিউশন! গতবছর উচ্চ মাধ্যমিকে একশোতে তিরানব্বই!’ এরকম সাইনবোর্ড যত ছিল সবগুলোর পাশে লাল কালিতে মোটা মোটা অক্ষরে শোভন লিখে দেয়- ‘৯৩ ! একশোতে একশো নয় কেন?’ দুদিন পরেই দেখে সব পোস্টার উধাও! আরেকটি বিজ্ঞাপনও শহর জুড়ে। ‘রূপকথা বিল্ডারস—আপনার স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার!’ শহরটি নতুন। ক্রমাগত বাড়ছে। তাই এই ধরণের বিজ্ঞাপন প্রচুর। শোভনের কবি-সত্তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিজ্ঞাপনের নিচে লিখে ফেলে ‘স্বপ্ন স্বপ্নই, সেটা পূরণ হলে মানুষ ঘুমোতে ভুলে যাবে!’
শহরে বিজ্ঞাপন কমে আসছে। লোকাল কেবলে টিভিতে বিজ্ঞাপনী প্রচার বেড়েছে। বেড়েছে বন্ধুদের মধ্যে রহস্য। রোজ রাতে শোভন মেস থেকে বেড়িয়ে কোথায় যায়! একদিন সব বন্ধুরা শোভনকে অনুসরণ করে গোপনে দেখে তার রাতের ক্রিয়াকলাপ। ‘গোপনে নেশা ছাড়ান’—তার পাশে শোভন লিখছে ‘গোপনে নেশা ধরান’। আড়াল থেকে বন্ধুরা তা দেখে উল্লসিত। ‘বিজ্ঞাপন মোছার নেশা’—পরের এই কথাটি যে শোভন লিখল, তা আর নজরে পড়ল না বন্ধুদের। ল্যাম্প পোস্টে আবার একটি টিউশনের বিজ্ঞাপন! ‘উচ্চ মাধ্যমিক দর্শন টিউশন! ১০০ তে ১০০’। শোভন এডিট করে লিখল, ‘উচ্চ মাধ্যমিক দর্শন টিউশন! ১০০ তে ০ পেয়ে দার্শনিক হয়ে যাও!’ দূর থেকে দেখে, শোভনের বিজ্ঞান-পড়া বন্ধুরা হাসাহাসি করে। হঠাৎ লোডশেডিং। আকাশে মেঘ সরে গেছে। নেশার মতো চাঁদের আলো উপচে পড়ছে রাস্তা জুড়ে। রাতপাখিরা ডেকে উঠল সমস্বরে! শোভন কাল ভোরে, মনিকর্ণিকার ঘাটে যাবে। কতদিন ডাহুকের ডাক শোনা হয়নি!
(মৃত্তিকা শবনম সম্পাদিত শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘শাপলা’য় প্রকাশিত)